এস আলমের শেয়ার থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকে ঘাটতি ২৪ হাজার কোটি টাকা

এস আলমের শেয়ার থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকে ঘাটতি ২৪ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের শেয়ার থাকা ৫ ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘বিশেষ ধার’ নিয়ে বছর শেষের চলতি হিসাব ইতিবাচক দেখিয়েছিলো। ধারের মেয়াদ শেষ হতেই এসব ব্যাংক আবার পড়েছে ঘাটতিতে। ব্যাংকগুলো হলো : ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) ব্যাংকগুলো প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে ছিলো। এর মধ্যে বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ (সিআরআর) বাবদ ঘাটতি ১০ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঋণাত্মক স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শেয়ার নিয়ে ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ অনিয়মের মাধ্যমে এসব ব্যাংকের আমানত নিজেরাই ব্যবহার করছে। আর অনিয়ম এবং জাল-জালিয়াতির কারণেই বর্তমানে ব্যাংকগুলোর এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের সঙ্গে প্রতিটি ব্যাংকের একটি চলতি হিসাব থাকে। এই হিসাব থেকে ব্যাংকের সিআরআর, এসএলআর সংরক্ষণ, আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া পুনঃঅর্থায়নসহ সব লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। বিদ্যমান নিয়মে কোনও ব্যাংকের চলতি হিসাবে টাকা না থাকলে লেনদেন হবে না– এটাই স্বাভাবিক। তবে মাসের পর মাস তা ঋণাত্মক হওয়ার সুযোগ নেই। তবে শরিয়াহ্‌ভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের হিসাব অনেক দিন ধরে ঋণাত্মক হলেও লেনদেন অব্যাহত আছে। ঘাটতি পরিস্থিতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় কয়েক দফা মৌখিক সতর্কতার পর গত ২৮ নভেম্বর পাঁচ ব্যাংকের এমডিকে সতর্ক করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, ‘মতিঝিল কার্যালয়ে রক্ষিত আপনাদের চলতি হিসাবের মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। দীর্ঘদিন ধরে আপনাদের চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক, যা স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিষয়টি বারবার আপনাদের গোচরীভূত করা হলেও উল্লেখযোগ্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। এ অবস্থায় চিঠি পাওয়ার ২০ কর্মদিবস তথা ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয় করতে না পারলে সব বা নির্দিষ্ট কোনও ক্লিয়ারিং প্ল্যাটফর্ম থেকে বিরত রাখা হবে।’

চলতি হিসাবে ঘাটতি মেটাতে না পারলে গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে চিঠি দেওয়া হলেও পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় নি। এরপর পাঁচ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে বছরের শেষ কর্মদিবস ২৮ ডিসেম্বর কোনও উপকরণ ছাড়াই ‘বিশেষ ধার’ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাঁচ ইসলামীসহ মোট ৯টি ব্যাংককে ওইদিন দেওয়া হয় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালের শেষ কর্মদিবসেও পাঁচ ইসলামী ব্যাংককে ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট’ হিসেবে ১৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা দিয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, এস আলমের শেয়ার থাকা এসব ব্যাংকে নানা অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির কারণে ২০২২ সালের শেষদিক থেকে ব্যাংকগুলোতে চরম তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়। দিন দিন এ সঙ্কট তীব্র হলেও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় নি। অনেক দিন ধরে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) এবং বিধিবদ্ধ তারল্য (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ জন্য জরিমানার টাকা দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। অন্য ব্যাংক থেকে ধারদেনা করতে হলে বিভিন্ন উপকরণ লাগে। তা না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘বিশেষ ধার’ এবং চলতি হিসাব নেতিবাচক নিয়েই চলছে পাঁচ ইসলামী ব্যাংক।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকলেও অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ করা হয় নি। তবে ঘাটতি কিছুটা সমন্বয় করেছিলো। ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানা নেই। তবে এ বিষয়ে কাজ চলছে।

কোন ব্যাংকের ঘাটতি কত :
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৪ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর হিসেবে রাখতে হয়। কোনও ব্যাংক এতে ব্যর্থ হলে অনর্জিত অংশের ওপর ৯ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হয়। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাব দীর্ঘদিন নেতিবাচক হওয়ার ঘটনা আগে ঘটে নি। গত ২৮ ডিসেম্বর তিনদিনের জন্য বিশেষ ধারের পরও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ঘাটতি মেটাতে পারে নি। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (মাসুদ)। গত ডিসেম্বর শেষেও ওই ব্যাংকের মোট ঘাটতি ছিলো ৪ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আর বছরের প্রথমদিন পহেলা জানুয়ারি ঘাটতি বেড়ে ৭ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা হয়। গত বৃহস্পতিবার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাব নেতিবাচক রয়েছে ৭ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আর ১ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা সিআরআর রাখার কথা থাকলেও এক টাকাও রাখতে পারে নি। বিশেষ ধারের কারণে অন্য চার ব্যাংক ডিসেম্বর শেষে সামান্য হলেও সিআরআর ও চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখাতে পেরেছে। তবে গত ৩১ ডিসেম্বর ধারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিন গত পহেলা জানুয়ারি থেকে আবার বড় ঘাটতিতে পড়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মোট ঘাটতি ছিলো ৯ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি হিসাবে নেতিবাচক ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা এবং সিআরআর বাবদ ৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। গত পহেলা জানুয়ারি ব্যাংকটির ঘাটতি ছিলো ৫ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মোট ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ছিলো চলতি হিসাব নেতিবাচক। বাকি ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা সিআরআর বাবদ। গত পহেলা জানুয়ারি ব্যাংকটির মোট ঘাটতি ছিলো ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকে মোট ১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা চলতি হিসাব নেতিবাচক এবং ৭৪৬ কোটি টাকা সিআরআর বাবদ ঘাটতি। গত পহেলা জানুয়ারি মোট ঘাটতি ছিলো ১ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট ৫২১ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকা সিআরআর ও ৩৮ কোটি টাকা চলতি হিসাব নেতিবাচক। গত পহেলা জানুয়ারি ব্যাংকটির মোট ঘাটতি ছিলো ৪৩০ কোটি টাকা।

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ওই পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) টেলিফোন করা হলেও একজনও তাঁদের বক্তব্য জানাতে পারেন নি। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের এমডি ফোন ধরলেও আপাতত এ বিষয়ে কোনও মন্তব্যে রাজি হন নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত হয় ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। আর্থিক প্রতিবেদনে যেনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি, সিআরআর ঘাটতিসহ বিভিন্ন খারাপ অবস্থার প্রতিফলন দেখাতে না হয়, সেজন্য এ উপায়ে ধার দেওয়া হয়েছে। এভাবে ঘাটতি সমন্বয়ের সুযোগ না দিলে ব্যাংকগুলোর এলসি কনফারমেশন চার্জসহ সব ধরনের খরচ আরও বাড়বে।